রবিবার
২৮ শ্রাবণ,১৪২৫
১২ আগস্ট,২০১৮
ঘুম থেকে ধরফর করে উঠেই ভাবলাম ঘুমায়ে পড়লে হবে না! নাহলে ত ট্রেনের করিডোরে মানুষের গায়ে পড়ে যাব! ভাবা যায় আমি কারো গায়ে পড়লে কি হবে! হুঁশ ফেরার পর চারিদিক দেখে ঘোর কাটল। না,আমি আর সেই ট্রেনে সিট আর উপরে হাতল ধরে দাঁড়িয়ে নাই! আমার নিজের বিছানায়, নিজের বালিশে, নিজের চাদরে গা জড়িয়ে উঠে বসে আছি! যে ট্রেনের কথা বলতেসি সে শুধু এক দুঃস্বপ্ন নয়,সদ্য ফেলে আসা অতীতের স্মৃতি, গতকাল রাতের স্মৃতি ! গতকাল সারাদিন হাঁটাহাঁটি,পরিশ্রমের পর কোথায় ট্রেনের কেবিনে আরাম করে ঢাকা ফিরবো তা না, আমাদের ঢাকায় ফেরার দিনটা এমন দিনেই পড়ল যখন সবাই শুক্র,শনি ছুটি কাটিয়ে ঢাকা ফিরছে! আর কি? যা হবার তাই হলো! কেবিন তো দূরে থাক সিটই পাইনি! চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা স্রেফ দাঁড়িয়ে ! বাসায় যখন ঢুকি ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে ৭ টায়! ঢুকতেই অনুভূতি হারানো কাঁপা কাঁপা পা নিয়ে বিছানার কাছে গিয়েই ঘুম! ধড়ফড় করে ওঠাটা দুপুর আড়াইটায়। ট্রেন ভ্রমণটা আমারদায়ক না হলেও সুখকর ছিল! সুখের কারণ বলতেই এই লেখা!
বুধবার
২৪ শ্রাবণ,১৪২৫
৮ আগস্ট ২০১৮
ঢাকায় আছি তা প্রায় তিন বছর। ২০০৮ সালের আগেও ছিলাম প্রায় ৮ বছর! কাজেই ঢাকার পরিবেশ নতুন না। তবে যারা আমাকে চিনে তারা অনেকেই বলে,"তুই আর ঢাকা দেখলিই বা কই! থাকিস তো ক্যান্টনমেন্টে। ঢাকায় থেকেও যান্ত্রিকতার বাইরে!" আমি ঢাকা চিনিনা ঠিক না,তবে যান্ত্রিকতার বাইরে শতভাগ ঠিক। তবে সেই আয়েশের জীবন যে চিরস্থায়ী না! আব্বু যখন চাকরি শেষ করে ৩০ বছরের স্মৃতি নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ছাড়ল,আমি তখন ভাবছি,যাক এবার ঢাকা দেখব,আসল ঢাকা! সে শখ আমার মিটে গেছে! এই আবদ্ধতা আর ভালো লাগছে না! আগেও যে বদ্ধ বদ্ধ লাগেনি তা না। তবে এই আবদ্ধতা ভেতর থেকে ভেঙে দিচ্ছিলো আমায়! যাহোক আবার আবদ্ধতা চিকিৎসা ঘুরাঘুরি করার পরিকল্পনাটা এবার আবিদের । সব সময় যেখানেই যাই যায়গাটা সম্পর্কে গবেষণা করাটা ভুলি না! এবার আমিই যেহেতু রোগী, ডাক্তারির ভারটা ওদের। ওদের বলতে আবিদ আর ফয়সাল। গ্রুপটা বিশাল বড় না! তবে মাত্র তিনজন পাবার মত ছোটও না -_- বাকি বজ্জাত গুলাকে এতো বলেও রাজি করাতে পারি নাই! সে যাই হোক রাতের ট্রেন। উঠবো কমলাপুর থেকে। রাত ৮ টার মধ্যেই ফকিরাপুলে উপস্থিত ! এতো আগে আসার ফায়দা নিতে আর রাতে ট্রেনে তিন খাদকের পেট পূজার সরঞ্জামের খোঁজে আবিদের খালার বাসায় যাওয়া হল। যাবার পথে ফ্রাইড রাইসের চিকেনটা বেছে কিনে এনেছি আমরাই ;) যাহোক,রাতের ট্রেনে কষ্ট বা বলার গল্প তেমন কিছুই হয় নি! যা হয়েছে তা আমাদের জন্যে অতীব সাধারণ। আমরা খালার ফ্রাইড রাইসের পরিমাণ দেখে ভাবছি সকাল বা দুপুর পার করে দেয়া যাবে! খাওয়া শুরু করে এর স্বাদে টেরই পেলাম না কখন দুপুর পর্যন্ত যাওয়ার চিন্তা ভুলে ২০ মিনিটেই বাটি খালি!!
ভৈরব স্টেশনে দেখা পেলাম এক পাগলা বাবার। ছবি তোলার ইচ্ছা পোষণ করার আগেই তিনি আমাকে বললেল,"ছবি তুলবেন নাকি!" । আমি সানন্দে তুলে ফেললাম। কথায় কথায় জানা হল বাবার নাম শাইখুল। যাচ্ছেন আখাওড়া,হেঁটে, একা!! তার দলের বাকিরা আগেই চলে গেছে। উনি একটা কাজে থেকে গেছিলেন ভৈরব। তার মুখে শুনলাম তার সাধনা তাকে কোথায় কোথায় নিয়ে গেছে। দিল্লি,রাজস্থান,আসাম, আর কতো জায়গা...! ও হ্যাঁ অবশ্যই হেঁটে! তার ভাষ্যমতে, "এই সব টাকা পয়সা দিন-দুনিয়া কিছুই না,সব থেকে বড় কথা মন! এই দেখেন পকেটে ১২ টাকা নিয়ে বাইর হইসি..বাকিটা উপরওয়ালা করে দিচ্ছেন!" এর পর ট্রেনের হর্ণ আর সেই ঝিক ঝিক শব্দ ছাড়া বাকি কিছু খেয়াল নেই। খেয়াল যখন হতে শুরু করল,সীতাকুণ্ড ততক্ষণে চোখের সামনে! ট্রেন থামলো প্ল্যাটফর্ম ছাড়া লাইনে। নেমে দূরে মিলিয়ে যাওয়া রেলের পাতে চোখ রেখে এগুচ্ছি আমরা তিনজন! দূরে চোখে পড়ছে আমাদের প্রধান গন্তব্য,চট্টগ্রামের সর্বোচ্চ পয়েন্ট "চন্দ্রনাথ পাহাড়"।
আমি তার একটা ছবি তোলার অনুমতি চাবার আগেই আমাকে বলেন,"ছবি তুলবেন নাকি?" |
বৃহস্পতিবার
২৫ শ্রাবণ,১৪২৫
৯ আগস্ট,২০১৮
চন্দ্রনাথ পাহাড়
যদিও আমাদের ৯ আগস্ট শুরু হয় সীতাকুণ্ড নামা দিয়ে তাও আমার কাছে ৯ আগস্টের শুরুটা চন্দ্রনাথ পাহাড় দিয়েই। সকালের নাশতা সেরে যখন চন্দ্রনাথ যাত্রা শুরু করি আকাশে রোদটা তখন চড়তে শুরু করেছে! পৌঁছাতে পৌঁছাতে রোদের তাপ গায়ে লাগার মতো! অবশেষে আসলো সেই শুভক্ষণ! আট-ঘাট বেঁধে আমরা শুরু করলাম চন্দ্রনাথ জয়ের অভিযান । কিছুটা উপরে উঠতে না উঠতেই দেখা দিলেন,পাহাড়ের চূড়ায় চন্দ্রনাথ মন্দির ও বামপাশে বিরূপাক্ষ মন্দির!
লক্ষ্য স্থির,বিরূপাক্ষ মন্দির! |
লক্ষ্য স্থির। এবার আগানোর পালা। শুরুটা খুবই রোমাঞ্চ নিয়ে। কিছুদূর পর বুঝলাম...আমি অতটা রোমাঞ্চ নিতে পারলেও আমার শরীর পারছে না! রোদের তাপে ভয়ানক ঘামে চোখের চশমা ভিজে গেছে ,পা আটকে আসছে! কিছু করতে না পেরে বসে পড়লাম! এমন দুবার হল। দ্বিতীয়বার এক চাচা আমার অবস্থা দেখে উপদেশ দিলেন তাড়াহুড়া না করতে। এতে ক্লান্তি আসবে না তাই বিরতি ছাড়াই তাড়াতাড়ি এগুনো যাবে। চাচার উপদেশ আসলেই বেশ কাজে লাগল! এরপর অতটা বেগ পেতে হয়নি উঠতে। আমরা উঠসি উপরে। মাঝে এক ছোট্ট ঝর্ণায় মুখ ধুয়ে পা চালাচ্ছি..। হাঁটার রাস্তার বর্ণনা দেবার ভাষাটা খুঁজে পাওয়াটা কষ্টকর! একটু বলি,পাহাড়ের গা ঘেঁষে অনেক আগে বানানো ইটের সরু সিঁড়ি। একপাশে তো পাহাড়..আরেকপাশে ? খাদ! কোনোভাবে একবার পড়ে গেলে উঠার উপায় দেখি না! ও হ্যাঁ বলা হয়নি আমার সফর সঙ্গী ফয়সাল। সে এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে পারে নি! প্রথম পরীক্ষার দিনই মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে ২/৩ মাস বিছানায় পড়া! তার সেই আধা ভালো হওয়া পা আর পুরো হতাশাক্রান্ত মন নিয়ে পাহাড়ে চড়তে আসা! এটা তার প্রথম ভ্রমণও বটে! কী অসাধারণ সূচনা তাই না?!
বিরূপাক্ষ মন্দির পৌছানোর পথে |
পাহাড় চড়া শুরু করি সকাল ৮ টায়। উপরে পৌঁছলাম সকাল ৯ টায়। উপরে বলতে বাম-পাশে বিরূপাক্ষ মন্দির।
আমার অনুভূতি!?
উপরে ওঠার প্রতি ফোঁটা ঘামের মূল্য সুদে আসলে শোধ করে দিলো সেই দৃশ্য! এক জায়গাতে দাঁড়িয়েই সীতাকুণ্ড শহর আবার দূরের কর্ণফুলী নদীতে চলা জাহাজ! সব থেকে অসাধারণ দৃশ্য,পাহাড়ের চূড়ার সেই দূর নীলে হারিয়ে যাওয়া সবুজের চাদর,ছোট পাহাড় আর লোকালয়!
দৃশ্য অসাধারণ হলে কী হবে, আমাদের লক্ষ্য এখনো অধরা! আমরা এখনো সর্বোচ্চ চূড়া থেকে ২০০ ফুট মতো নিচে! যদিও এই পথটা অতটা কঠিন ছিল না,যাত্রাটা অবাক করা অভিজ্ঞতা! দুপাশে পাহাড়ি ঝোপঝাড়। মাঝখান দিয়ে সরু হেঁটে চলার রাস্তা। সেটা পেরুলে সেই দুর্ধর্ষ খাদের রাস্তা! একপাশে পাহাড়ি ঝোপ অন্য পাশে দূরের নীলে হারিয়ে যাওয়া সবুজ পাহাড়! এই দৃশ্য চোখে আর মনে অনুভূত হতে হতে রাস্তার ভীতিটা মনে অনুভূত হবার সুযোগই পায় নি!!
বিরূপাক্ষ মন্দির |
সর্বোচ্চ চুড়ায় যখন পৌঁছেছি সময় তখন সকাল ১০ টা বেজে ১০ মিনিট। চন্দ্রনাথ জয়ের আনন্দে মন ভরার আগেই দূর পাহাড়ের দৃশ্যে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল!! যদিও এটা হারিয়ে যাওয়া দৃশ্য না..তবে এটার সৌন্দর্য কোনো অংশে কম না! আমি চন্দ্রনাথ মন্দির চুড়া থেকে বাম-পাশের বিরূপাক্ষ মন্দির এর দৃশ্যের কথা বলছি! চারপাশে সবুজে বেষ্টিত ছোট্ট একটা লালচে দেয়ালের মন্দির,যেখান থেকে বেড়িয়ে এসেছে সাপের মত আঁকা বাঁকা সরু একটা হাঁটার রাস্তা!
সবুজে বেষ্টিত ছোট্ট একটা লালচে দেয়ালের মন্দির,যেখান থেকে বেড়িয়ে এসেছে সাপের মত আঁকা বাঁকা শরু একটা হাটার রাস্তা! |
চট্টগ্রাম জেলার সর্বোচ্চ স্থানে বসে চারদিকের দৃশ্য উপভোগ আর কভার ফটো অনুসন্ধান শেষে এবার নিচে নামার পালা! চন্দ্রনাথ থেকে নেমে যাওয়া সিঁড়ি ধরে একটু একটু করে নামছি আর পরবর্তী গন্তব্য কি হবে তাই ঠিক করছি! সবুজ শ্যাওলা ঢাকা লাল ইটের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ছোট্ট ঝর্ণার দেখা পেলাম। পাহাড়ে উঠতে রোদ আমাদের এত কাবু করেছে যে আমরা প্রায় ১৫০ টাকার পানি কিনে শেষও করে ফেলেছি! ঝর্ণায় গা ভিজিয়ে পানি ভরে আবার সমতলের উদ্দেশ্যে যাত্রা!
চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় আমরা তিনজন (বাম থেকে আমি,আবিদ,ফয়সাল) |
মহামায়া লেক
দুপুরের খাওয়া সেরে অনেক তক্কাতক্কির পর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলো মহামায়া লেক যাবো আমরা। যাবার মূল উদ্দ্যেশ্য কায়াকিং করা। পড়ন্ত বিকেলে লেকের মাঝে কায়াকিং করার সিদ্ধান্তটা সব যুক্তিতর্ক ,shortest path argument ছাপিয়ে বড় হয়ে দাঁড়ালো! সীতাকুণ্ড ব্রিজ থেকে বাসে করে মহামায়া যেতে সময় লাগলো পৌনে এক ঘণ্টা। যখন লেকে পৌঁছাই বেলা তখন ৩ টা! চড়া রোদ আর জনমানবহীন লেক দেখে যদিও সাময়িকভাবে অবাক হয়েছি তবে পরবর্তীতে বুঝলাম বৃহস্পতিবার, এই ভরদুপুরে আর কতোই বা লোক থাকবে? যাহোক কায়াকিং করতে গিয়ে পড়লাম এক বিপাকে! কায়াকিং বোটে লোক ধরে ২ জন আমরা আছি ৩ জন! ছাত্র হিসেবে ছাড় পেয়ে ২০০ টাকা প্রতি ঘণ্টা করলেও একা ২০০ টাকা খরচ করা বেশিই হয়ে যায়! তাছাড়া একা যাওয়াটা অতটা মজা হবে বলে মনে হচ্ছে না ! শেষে তাদের অনুরোধ করে ২৫০ টাকায় ৩ জনের ব্যবস্থা হল। প্রথমে দুইজন যাবে,ফিরে এসে একজনের সাথে স্থান বদল হবে! আর আবিদ যেহেতু নৌকার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বরিশাইল্যা রক্ত! তাই বদলাবদলি আমার আর ফয়সালের মধ্যেই হবে। প্রথমে ফয়সাল আর আবিদ গেল। ফিরে এসে আমাকে নিয়ে বেরুল আবিদ! ফয়সাল ক্যামেরা নিতে সাহস না পেলেও আমি ঠিকই গলায় ঝুলিয়ে নিলাম! লেকের মাঝে বৈঠা কনুই দিয়ে চেপে ধরে ছবিও তুললাম কিছু!
মহামায়া লেকে কায়াকিং |
আমার ছবির স্বল্পতার কথা ভেবে আবিদ লেকের এক দ্বীপে নৌকা নোঙর করে আমাকে ছবি তুলে দিল! যাহোক প্রায় বেশ খানিকটা লেক ঘুরে ঘড়িতে সময় দেখে পাক্কা এক ঘন্টা শেষ হবার সাথে সাথেই পাড়ে ফিরে আসলাম! ফিরে আসতে আসতে ছায়া পড়ে গেছে। বিকেলের নরম রোদে লেকের পানির উপর পা ঝুলিয়ে তিনজন বসে বেশ খানিকটা সময় পার করে দিলাম।
আজকের দিনের ক্লান্তির পর এবার একটু বিশ্রামের পালা। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এবং দাওয়াতের সুবাদে রাত্রিযাপন করতে যাত্রা করলাম চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে,মূল গন্তব্য পতেঙ্গা,বিমান বাহিনী ঘাঁটি জহুরুল হক,আমাদের বন্ধু সুমাইয়ার বাসায়। লেক থেকে বেরিয়েছিলাম ৬ টার দিকে, পৌঁছতে পৌঁছতে রাত ১০ টা। সারাদিনের ক্লান্তি গোসলে ধুয়ে আন্টির বিখ্যাত রান্নায় ডুবে গেলাম! এই রান্নার গল্প অনেক শুনেছি, স্বাদ নেয়া এই প্রথম। রাতে খাবার পর গল্প, আড্ডা আর পরিকল্পনা শেষে ঘুম দিয়ে একটা অসাধারণ দিনের অবসান।
শুক্রবার
২৬ শ্রাবণ,১৪২৫
১০ আগস্ট,২০১৮
এই দিনের পরিকল্পনা ছিল বাঁশবাড়িয়া আর গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত। আগের দিনের ক্লান্তিতে যা হয় আর কি,ঘুম উঠতে দেরি ! তাই সেই পরিকল্পনা বাতিল । একটু দেরি করে বের হয়ে সিদ্ধান্ত হলো চট্টগ্রাম শহর ঘুরবো আজ। আমাদের গাইড হবার কথা সুমাইয়ার নিজের। তবে সে যা বলল তাতে আমরা হতাশ । তার নিজের তেমন ভালো করে চেনা নেই চট্টগ্রাম শহর। যাহোক সেটার সমাধান হলো তার বন্ধুদের ডাকা। সেটাই করা হলো। নিউমার্কেট হয়ে ওর বন্ধুদের কোচিং এ গেলাম। সেখান থেকে কাছে বলে হেঁটেই চলে গেলাম অভয়মিত্র ঘাট। যায়গাটা নিরিবিলি,তবে এই ভরদুপুরে রোদের মধ্যে যাওয়াতে আমার দুই সফর সঙ্গী আবিদ আর ফয়সালের চাঁদ মুখখানা কালো হলে গেল! যাহোক সেখান থেকে ফিরে এবার দুপুরে খাবার পালা! আমরা খেলাম চট্টগ্রাম পুরাতন রেলস্টেশনের কাছেই নিজাম হোটেলে। এটা সুমাইয়ার ট্রিট। কাজেই আমাদের খাওয়া আটকায় কে? খাবার পর রোদে পোড়া শহরের মাঝে একটু শান্তি পেতে সি.আর.বি আর টাইগার পাস এলাকায় গিয়ে বসলাম।
পারকি সমুদ্র সৈকত
পতেঙ্গা বন্ধ থাকায় এবং আগে সবাই গিয়েছি বলে সূর্যাস্ত দেখার গন্তব্য ঠিক করা হল পারকি সমুদ্র সৈকত। টাইগারপাস, নেভাল,১৫ নাম্বার ঘাটে কর্ণফুলী পারাপার, CUFL ঘাট থেকে CNG করে যখন পারকিতে পৌঁছলাম সময় তখন বিকাল সাড়ে ৫ টা। পড়ন্ত বিকেল, একপাশে জোয়ারে আটকে যাওয়া জাহাজ আর আরেকপাশে জেলেনৌকায় পূর্ণ সমুদ্র! পড়ন্ত বিকেলের সূর্য আর সমুদ্র থাকলে ছবি তোলার লোভ কেই বা সামলাতে পারে?
ছবি তুলছি এমন সময় এক লোক আমাদের ডাক দিলেন।
-"ভাইয়ারা কোথা থেকে এসেছেন?"
-"ঢাকা থেকে"
- "এখানে এসে কেমন লাগছে?"
- "হ্যাঁ, বেশ ভালো"
- "পারকি বিচ সম্পর্কে কবে জানতে পারলেন?"
- "এইতো ২/৩ মাস আগে"
- "আমি Asian TV থেকে,আসলে একটা রিপোর্ট করছি। আপনারা কি কথা গুলা একটু ক্যামেরার সামনে একটু গুছিয়ে বলতে পারবেন?"
- "আসলে আমি ক্যামেরার সামনে খুব একটা confortable না! এই আবিদ, তোরা যা"
Asian TV-এর সাক্ষাৎকারে আবিদ আর ফয়সাল |
হ্যাঁ, আমি আসলেই যাইনি ক্যামেরার সামনে। আবিদ আর ফয়সাল ছিলো। আর আমাদের আবিদকে যারা চিনেন তারা জানেন দুইটা সময় তার মুখের ভাষা শুনে আমরা অবাক না মুগ্ধ হই, এক, কোনো আনুষ্ঠানিক পরিস্থিতিতে কারো সাথে কথা বলতে গেলে, দুই সামনে কোন সুন্দরী রমণী থাকলে :p প্রথম পরিস্থিতির কথা জানি না,দ্বিতীয়টার জন্যে আমরা তাকে সেই পচান দেই। এবার আমরা তার সেই রুপ আবার দেখতে পারলাম ক্যামেরার সামনে! শেষ করার পর ফয়সাল বলতেসিলো, "আমি যে কীভাবে হাসি চেপে রাখসি,আমি পেট ভেঙে হাসি পাচ্ছিলো।"
এই হাসি-মজায় সময় যে কীভাবে পার হয়ে গেল টের পেলাম না । আকাশ লাল রঙে রাঙিয়ে সূর্য অস্ত যাবে যাবে করছে। আমাদের সময় প্রায় শেষ! কারণ পারকিতে এখনো রাতে থাকার ব্যবস্থা নেই! তাছাড়াও এখান থেকে সন্ধ্যার পর ফেরা নিরাপদ না বলেই সবাই বলছিলো !! তার থেকে বড় কথা নদী পার হবার পর ১০ মিনিটের রাস্তায় আমাদের আপ্যায়ক সুমাইয়ার বাসা :D । আকাশ আমার চোখকে কখনো হতাশ করে না। বিশেষ করে সূর্যাস্তের আকাশ। আবার যদি সেটা হয় সমুদ্রের পাশে তাহলে তো কথাই নেই! চারপাশে তাকিয়ে দেখি অস্ত যাওয়া সূর্যের লাল আলো মেঘের সাথে মিলেমিশে এক অপূর্ব দৃশ্য তৈরি করেছে! ক্যামেরাটা উঠিয়ে কিছু ছবি না নিয়ে পারলাম না!
পারকি সমুদ্র সৈকতে সূর্যাস্ত |
সমুদ্রকে বিদায় দিয়ে আমরা ফিরে এলাম ১৫ নাম্বার ঘাটে। অন্ধকারে বসে কর্ণফুলীর হাওয়া খাচ্ছি আর সাথে খাচ্ছি সেখানকার একটা বিখ্যাত খাবার...। ক্লান্তিকর এক দিন শেষে বাসায় ফিরে আবার আন্টির আপ্যায়ন। এবার খাবার মেন্যু খিচুড়ি,ইলিশ মাছ,ডিম আরো কত কি...! ;)
শনিবার
২৭ শ্রাবণ,১৪২৫
১১ আগস্ট,২০১৮
বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত
বন্ধুরা একসাথে থাকলে যা হয় আগের রাতে তাই হলো, অনেক রাত পর্যন্ত গল্প। গল্প শেষ করে ঘুমাতে কিছুটা দেরি । পরিকল্পনা ছিল সকাল ৭ টার মধ্যে বের হবো। সীতাকুণ্ড ঘুরে একেবারে ঢাকা ফিরব। আবার সকালে উঠতে দেরি! সুমাইয়ার বাসা থেকে বিদায় নিয়ে বের হতে হতে ৯ টা। পতেঙ্গা থেকে চট্টগ্রাম শহরের রাস্তায় বাসে বসে বিনামূল্যেই রোলার কোস্টারের মজা নিয়ে অলংকার মোড় পৌঁছলাম। অলংকার মোড় থেকে সীতাকুণ্ডের বাসে উঠে নামলাম বাঁশবাড়িয়া বাজার। সেখান থেকে বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত। জোয়ারের জন্যে সৈকত আর সেই বিখ্যাত লোহার ব্রিজ দেখা হল না! যেহেতু আমাদের আরো কিছু জায়গায় যেতে হবে তাই দেরি করলাম না। সমুদ্রের ঢেউয়ের ঝাপটায় গা ভিজিয়ে বেরিয়ে পরলাম পরের গন্তব্যস্থলে।
"যতদূর চোখ যায় ঢেউ ঢেউ..ওপারে আছো কি কেউ কেউ " - বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকতে আবিদ |
গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত
সীতাকুণ্ড শহরে ফিরে খাওয়া শেষ করে এবার আমাদের যাত্রা গুলিয়াখালী। যাবার তেমন বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই। CNG নিয়ে একেবারে চলে যেতে হয়। CNG করে গ্রামের আঁকা-বাঁকা, কাঁচা-পাকা রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে পৌঁছে গেলাম গুলিয়াখালী। CNG থেকে নেমে পেছনে তাকিয়েই চোখ আটকে গেলো! সেই দুদিন আগে জয় করা চন্দ্রনাথ পাহাড় দিগন্তরেখা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে! সামনে এগুতেই দেখি লোকের জটলা। একটু নামতেই বুঝলাম সৈকতে যাবার রাস্তায় আমাদের বাঁধা, কাদা! শুধু একটু আধটু কাদা না,একেবারে আদর্শ কাদা। আমরা জুতা হাতে নিয়ে একটু একটু করে এগুচ্ছি। আমরা বলতে আমি আর ফয়সাল। সেই আগের মতোই, আদর্শ বরিশাইল্যা আবিদ ধুমধাম চলছে! বেশ কিছুদূর সামনে এগিয়ে গিয়ে তার উক্তি,"ভাই, আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে নতুন হাঁটা শিখতেছেন!"
"ভাই আজ বুঝলাম পায়ের আঙ্গুল কী কাজে লাগে!!" |
কাদার যে অবস্থা! আর হাতে ক্যামেরা,কাঁধে ব্যাগ নিয়ে এই কাদায় অভ্যাস না থাকলে আসলেই নতুন হাঁটা শেখার মতোই অবস্থা হবে! আমি সাবধানে এগুচ্ছি,পেছন থেকে ফয়সাল বলতেছে,"ভাই, আজ বুঝলাম পায়ের আঙ্গুল কী কাজে লাগে!!" ও হ্যাঁ, এইফাঁকে ফয়সালের অবস্থা দেখে তার প্রতি আবিদ,"তুই তো ব্যাটা বরিশাইল্যাদের নাম ডুবাবি!!" ও হ্যাঁ, ফয়সালও বরিশাইল্যা :p ৷
অনেক কাদা আর গাছের গুঁড়ি দেয়া ছোট নালা পার করে যখন সৈকতে পৌঁছলাম, চোখ আটকে গেলো। আগে যদিও ছবিতে দেখেছি, কিন্তু এমন দৃশ্য ছবিতে আর বাস্তবে দেখার মধ্যে বিস্তর ফারাক। চারিদিকে তাকালেই দেখছি সবুজ কার্পেটের মত ঘাসে মোড়া ছোট ছোট ঢিবি। যেনো যত্নে সাজানো কোনো এক অভিজাত গলফকোর্স! ঢিবির মাঝে মাঝে গর্তে সমুদ্রের পানি জমা ,তার ভেতরে আবার শ্বাসমূল বের করে দাঁড়িয়ে আছে কেওড়া গাছ।
গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত |
যাহোক, জোয়ারের পানি তখনো নামেনি। আবিদ দেখি গা ভিজাতে ভিজাতে নেমে অনেক দূর চলে গেছে! আমিও একটু পরে গেলাম। কোমর সমান পানি হলে কী হবে? পাড় থেকে বেশ দূরে। গা ভিজিয়ে এসে সাগর পাড়ে ঘাসের গালিচার উপর বসে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে দিলাম। সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম ফিরে ঢাকার ট্রেন ধরতে হবে বলে সেই সবুজ গালিচা ছেড়ে কাদার সাগর পাড়ি দিয়ে ফেরার যাত্রা করতে হলো।
গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে ফেলুদা ;) |
চট্টগ্রাম পৌঁছানোর পরের গল্প আর তেমন আলাদা কিছু না। আগেরদিন অভয়মিত্র ঘাটে চড়া রোদে মজা না পাওয়ায় আজ রাতের আঁধারে আবার গেলাম। কিছুক্ষণ গল্প করে কাটিয়ে চট্টগ্রামের কাচ্চির স্বাদ নিতে নিউ জামান হোটেলে ঢুকা হল। এরপর আর কী, আমাদের স্বভাবসুলভ কাজকর্ম সেরে রেলস্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরার পালা। আর সেই ট্রেনভ্রমণের দুরবস্থার কথা দিয়েই আমার লেখা শুরু হয়েছিলো।
Difficult roads often lead to beautiful destinations
আমাদের এবারের আমাদের এবারের ভ্রমণটা এই উক্তির সবচেয়ে ভাল উদাহরণ। আমাদের যাওয়া প্রায় প্রতিটা যায়গাতেই রাস্তা গুলো ঠিক জাতের ছিল না! আমি অবস্য ব্যক্তিগতভাবে নতুন নতুন জায়গা দেখতে পছন্দ করি। এই ভ্রমণের প্রায় প্রতিটা জায়গা আমার কাছে নতুন তো বটেই, বাংলাদেশের ভ্রমণপ্রিয় মানুষজনের কাছেও নতুন। খুব বেশি একটা মানুষ সবগুলো যায়গা সম্পর্কে জানে না। এই নতুনত্বটাই আমাকে বেশি পাগল করে। যা দেখলাম জায়গাগুলা এখনো সেভাবে অবকাঠামোগতভাবে উন্নত হয়নি! এটা একদিক থেকে ভালো, কারণ আমার মতো মানুষ খুব উপভোগ করবে আবার অন্যদিক থেকে অতোটা ভালো না। হয়তো অবকাঠামো আরো উন্নত হলে আরো অনেকে জায়গাগুলো উপভোগ করতে পারবে।
শেষে বলতে হয় পাহাড়, সমুদ্র আর একটুখানি ঝর্ণায় এই কয়টাদিন অনেক ভাল কেটেছে। এবার ব্যস্ত জীবনে ফেরার পালা! আবার কোন এক সময় ব্যস্ততা কমলে আবার বের হব!
Comments
Post a Comment